মো. নুর আলম, রূপগঞ্জ: অভাব অনটনের সংসারে পরিবারের হাল ধরতে অটোর স্টিয়ারিং হাতে নিয়েছেন অদম্য সংগ্রামী নারী হেনা বেগম। প্রায় এক বছর যাবত অটো চালিয়ে পাঁচ সদস্যের পরিবারের অন্ন জুগিয়ে চলেছেন তিনি। অন্যের জমিতে ঘর তুলে কোনরকম মাথা গোঁজার আশ্রয় হলেও, অটোরিকশার চাকা ঘুরলে তবেই ঘোরে হেনার সংসারের চাকা।
অটোরিকশা চালালেও বুক ভরা অনেক স্বপ্ন তার। নিজের একখন্ড জমিতে একটি ঘরের স্বপ্ন আর ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করার অদম্য ইচ্ছা শক্তিই তাকে অভাব অনটনের সাথে সংগ্রাম করতে শিখিয়েছে।
প্রায় এক দশক আগে রূপগঞ্জ সদর ইউনিয়নের পিতলগঞ্জ এলাকার হাসান মিয়ার পুত্র হাফিজুর রহমানের সাথে বিবাহ হয় হেনার। প্রথম দিকে ভালোই চলছিল তাদের সংসার কিছুদিন পরে তাদের ঘর আলো করে জন্ম নেয় এক পুত্র সন্তান। সেই সন্তান হোসাইনের বয়স এখন সাত বছর। কিন্ডার গার্ডেন স্কুলে প্লে শ্রেণিতে ভর্তি করিয়েছেন তাকে। স্বামীর উপার্জনে শ্বশুর-শাশুড়ি আর সন্তান নিয়ে অভাব অনটনে খেয়ে না খেয়ে কোনরকম চলছিলো তাদের পাঁচ জনের সংসার। সংসারের ঘানি টানতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন রাজমিস্তি স্বামী। অসুস্থতা এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায় যে, কোনো ভারী কাজই করতে পারছিলেন না তিনি। অভাব-অনটনে সংসার আর চলছিলো না। তখন, ব্যয় যোগাতে এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে স্বামীকে অটোরিকশা কিনে দেন। কিন্তু তাতেও কিস্তির টাকা পরিশোধের পর পরিবারের খাবারের যোগান আর ছেলের লেখাপড়ার খরচ চালানো কঠিন হয়ে যায়। দিশেহারা হয়ে পরেন হেনা। একদিকে সংসার খরচ অন্যদিকে ঋণের কিস্তির চাপই অটো চালাতে বাধ্য করেছে হেনাকে।
অভাব অনটন নিয়ে স্বামীর সাথে প্রায়ই ঘটত বাক বিতন্ডা। এরই সূত্র ধরে অভিমান করে একদিন চলে যান বাবার বাড়ি। পরে এক আত্মীয়ের পরামর্শে সিদ্ধান্ত নেন অটোরিকশা চালানোর। সেখানেই রপ্ত করেন রাস্তায় অটো চালানোর সকল কলা-কৌশল। আবার আরেক এনজিও থেকে নেন লোন। সে টাকা দিয়ে পুরনো একটি অটো কিনে স্বামীর সাথে সংসারের খরচ মেটাতে বেছে নেন এক আত্যপ্রত্যয়ী সংগ্রামী জীবন। ডেমরা-কালিগঞ্জ সড়কসহ রূপগঞ্জের অভ্যন্তরের বিভিন্ন সড়কে অটোরিকশা চালানো শুরু করেন। হেনার অটোরিকশার চাকা ঘুরলেই পরিবারে জোটে অন্ন, সবার মুখে ফোটে হাসি। প্রথম প্রথম ভয়ে হাত কাঁপলেও সময়ের ব্যবধানে সব সামলে নিয়েছেন তিনি। চালক হিসেবেও হয়েছেন অনেকটা দক্ষ।
উপজেলার রাস্তা-ঘাটে যাত্রী নিয়ে চলাচল করতে গিয়ে মানুষের অবহেলা আর কটু কথাকে হজম করেছেন। সবকিছু পেছনে ফেলে রাস্তা-ঘাটে অটো রিকশায় যাত্রী পরিবহনে হেনা এখন অন্যদের সাথে সমান তালে চলেন। যানজটের কারণে রাস্তায় পুরুষ চালকরা যেখানে হিমসিম খায়, সেখানে প্রায় বছর ধরেই নির্বিঘ্নে অটোরিকশা চালাচ্ছেন তিনি। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অব্দি অটোরিকশা চালিয়ে ৬শ থেকে ৮শ টাকা রোজগার করলেও তার বড় অংশ চলে যায় এই পুরোনো অটোর মেরামত কাজে। দুজনের যৌথ রোজগারে পরিবাবারের সকল চাহিদা মিটিয়ে সন্তানের লেখাপড়াও চলছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, ডেমরা-কালীগঞ্জ সড়কে অটোরিকশা নিয়ে যাত্রী ডাকছেন হেনা। পিতলগঞ্জ, হাড়িন্দা, মধুখালী, বেলদী, কাঞ্চন ব্রীজ, নীলা মার্কেটসহ পূর্বাচলের সড়ক গুলোতে সর্বত্রই যাত্রী পরিবহনে হরহামেশাই দেখা যায় তাকে। বলতে গেলে সবাই তার প্রতি সহানুভুতিশীল। অন্য অটোচালকরাও তাকে সহযোগিতা করেন।
জীবন সংগ্রামী হেনা বেগম ক্লিক নারায়ণগঞ্জকে বলেন, স্বামীর আয়ে ছেলে, শ্বশুর-শাশুড়িসহ পাঁচ জনের সংসারে একবেলা আধাবেলা খাবার জুটতনা। খেয়ে না খেয়ে কতদিন থাকা যায়। তাই বাধ্য হয়েই এ পেশা বেছে নিয়েছি। প্রথম প্রথম যাত্রী কম উঠলেও এখন সমান তালেই যাত্রীরা আমার অটোতে আসা-যাওয়া করে। প্রতিদিন ৬শ থেকে ৮শ টাকা রোজগার করলেও আয়ের বেশ কিছু অংশ পুরোনো অটো মেরামতেই খরচ হয়ে যায়। তার ওপর কিস্তির টাকা পরিশোধের চাপ। একটি নতুন অটোর ব্যবস্থা হলে সংসার নিয়ে আরও ভালোভাবে চলা যেত।
স্থানীয় অটোচালক বাবুল মিয়া বলেন, আমাদের এখানে হেনা আপাই একমাত্র নারী অটো চালক। তিনি খুব সাবধানে দক্ষতার সাথে যাত্রী পরিবহন করে থাকেন। তাকে আমরা সব সময় সহযোগিতা করি।
স্থানীয় এক যাত্রী আক্তারুজ্জামান মোল্লা বলেন, আমি অনেকবার তার অটোতে চড়েছি। তিনি রাস্তায় খুবই সাবধানতার সহিত যাত্রী পরিবহন করে থাকেন।
রূপগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য আব্দুল কাউয়ুম বলেন, হেনাকে আমরা বিভিন্ন সময়ে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সহযোগিতা করে আসছি। ভবিষ্যতেও তার সহযোগীতায় পাশে থাকব।
রূপগঞ্জ থানার পুলিশ পরিদর্শক দিপক চন্দ্র সাহা বলেন, বিষয়টি আমার জানা নাই। তবে তার নিরাপত্তার বিষয়ে আমাদের সজাগ দৃষ্টি থাকবে।
রূপগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা অফিসার মো. ইসরত জাহান ভূঁইয়া বলেন, বিষয়টি আমার জানা নাই এখন জানতে পারলাম। তিনি যদি আমাদের দপ্তরে যোগাযোগ করেন, তাহলে আমরা তাকে ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান করে কিংবা ঘরে বসে আয় করতে চাইলে সেলাই মেশিন দেওয়ার মাধ্যমে স্বাবলম্বী হতে সহযোগিতা করবো।
ক্লিক নারায়ণগঞ্জ/৬জুন/এনএ/এমএস