এম. হাসান: প্রায় ২০০ বছর ধরে তাবিজ তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন রূপগঞ্জের টানামুশুরী, ভিংরাব ও দক্ষিণবাগ গ্রামের বাসিন্দারা। এ গ্রামগুলোতে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের বসবাস। এখানে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই তৈরি হয় তাবিজ। তিন প্রজন্ম ধরে তাবিজ তৈরির এ ঐতিহ্য বজায় রেখেছেন তারা।
ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় এখন কিছু অটোমেটিক মেশিন দিয়ে তাবিজ বানানো হলেও, রূপগঞ্জের এই গ্রামগুলোতে ২০০ বছরের পুরনো সনাতনী পদ্ধতিতে তৈরি তাবিজ এখনও সারাদেশে যায়। মহাজনরা এখান থেকে কম পয়সায় বেশি তাবিজ কিনতে পারেন পাইকারি হারে। কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেটসহ দেশের নানা এলাকা থেকে লোকজন এখানে এসে তাবিজ কিনে নিয়ে যান।
সরেজমিন দেখা যায়, ঢাকার জিঞ্জিরা ও বিভিন্ন পাইকারি বাজার থেকে কেজি দরে লোহার পাত ও টিনের টুকরো কিনে আনা হয় তাবিজ তৈরির কাঁচামাল হিসেবে। এরপর সেই পাতগুলোকে কাটা হয় মাপ অনুযায়ী। নির্দিষ্ট মাপে পাতগুলোকে কাটতে ব্যবহার করা হয় ‘কাতানি’ নামে বিশেষ এক ধরণের কাঁচি। কাটার পর ছোট সিলিন্ডার আকৃতির লোহার সঙ্গে পাতটিকে হাঁতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে সিলিন্ডারের আকৃতি দেওয়া হয়। এভাবেই তৈরি হয় তাবিজের প্রাথমিক রূপ।
এরপরে পর্যায়ক্রমে আরও বেশ কিছু ধাপ পেরিয়ে তৈরি হয় এক একটি তাবিজ। তিন গ্রামের তাবিজ তৈরির কারিগরদের ভাষায় ধাপগুলোকে বলা হয় যথাক্রমে ‘চান্দাইড়’, ‘কোড়া’, ‘বান্ধন’ ও ‘আপড়’। উল্লিখিত ধাপগুলোর কর্মযজ্ঞ শেষ হলে তাবিজগুলোকে রেতি দিয়ে ঘষে উজ্জ্বল করলেই সম্পূর্ণ হয় তাবিজ বানানোর লম্বা প্রক্রিয়া।
দিলীপ নামে তাবিজ তৈরির এক কারিগর ক্লিক নারায়ণগঞ্জকে বলেন, ‘আমরা প্রতি মাসে দশ-বারো হাজার তাবিজ বানাই। মহাজনের কাছে একেকটা বিক্রি করি ৪০ থেকে ৬০ পয়সা করে। মহাজন সেগুলো ১০, ২০, ৩০ টাকা যেভাবে পারেন বিক্রি করেন।’
কণ্ঠে আক্ষেপ ঝড়িয়ে তিনি আরও জানান, এখন এ ব্যবসায় লাভ কম। আগে বাণিজ্য বেশি ছিল, লাভও বেশি হতো। এখন লাভ কম। কয়দিন এ কাজ চালাতে পারব জানি না। বাপ-দাদা করত, তাই আমিও করি। এ কাজটাই মন দিয়ে শিখেছি, আর কিছু পারি না।
৫০ বছর ধরে এই পেশায় নিয়োজিত থাকা বৃদ্ধ সিরাজুল হক ক্লিক নারায়ণগঞ্জকে বলেন, বাবা, আমি তো এক জীবন পার করলাম এই কাজ করে। বাপ-দাদার এ কাজ কোনোদিন ছাড়তে পারিনি। রক্তে ঢুকে গেছে এ কাজ। দিন যত যাচ্ছে, তাবিজের দাম তত কমছে। বিশ বছর আগেও এক মাসে তাবিজ বানিয়ে যত আয় হতো, এখন তার তিন ভাগের এক ভাগও আসে না। এখন দিন আনি দিন খাইয়ের মতো অবস্থা হয়ে গেছে আমাদের।
দেশ স্বাধীন হবার আগে বাবার হাত ধরে এ পেশায় যুক্ত হয়েছিলেন সিরাজুল। শৈশবে দাদাকেও একই কাজ করতে দেখেছেন। এখন তার ছেলেরাও তাবিজ বানায়।
প্রায় দুই শতাব্দীর পুরনো তাবিজ তৈরি পেশার কারিগররা বর্তমানে ভালো অবস্থায় নেই। সেকারণেই পূর্বপুরুষের হাত ধরে যুক্ত হওয়া এই পেশায় পরবর্তী প্রজন্মকে আনতে চান না এখানকার কারিগরেরা।
জানা যায়, দুই শতাব্দীর ঐতিহ্যকে বহন করে চলা রূপগঞ্জের তিন গ্রামের মানুষের তাবিজ তৈরির এই সুনিপুণ কাজকে সরকারিভাবে কোন স্বীকৃতি দেয়া হয়নি আজও। তাবিজ বিষয়টি ধর্মীয় আবেগের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে এটিকে কুটির শিল্পের আওতাভুক্তও করা হয়নি। এ তিন গ্রামের মানুষের একটাই চাওয়া— দেশের অন্যান্য কুটির শিল্পের মতো তাদের কাজকেও যেন স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলামের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে রূপগঞ্জ সদর ইউনিয়নের প্রশাসকের দায়িত্বে থাকা উপজেলার সহকারি কমিশার (ভূমি, পূর্বাচল সার্কেল) ওবায়দুর রহমান শাহেল এ বিষয়ে ক্লিক নারায়ণগঞ্জকে বলেন, আমি এখানে জয়েন করেছি খুবই অল্পদিন হলো। এই বিষয়টি আমার জানা ছিলনা, আপনার থেকেই জানলাম।
তিনি আরও বলেন, জেনে খুবই ভালো লাগছে যে এ এলাকার মানুষ এত পুরনো একটা পেশা এখনও ধরে রেখেছেন। আমি ব্যক্তিগত ভাবে তাদের খোঁজ নিবো। আমরা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদেরকে মেইনস্ট্রিমের সাথে যুক্ত করতে সবরকম চেষ্টা করবো।
সিএন/এমএস